সূর্য উদয়ের দেশ জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য প্রতি বছর অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করার জন্য আসে। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহনের এই রকম চাহিদা হওয়ার কারণ টিউশন ফি সেখানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এবং জ্ঞান অর্জনের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসাবে, জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা অন্যান্য সভ্যতা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে এই দেশের জুড়ি মেলা অসম্ভব। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে মেডিসিন, সাহিত্যে, ব্যবসা এবং প্রশাসন যে কোন বিষয়ে আপনি জাপান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়াশুনা করতে পারবেন। তাই প্রতি বছর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশ থেকে মেধাবি শিক্ষার্থীরা জাপানে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করার জন্য।
তাই আজ আমরা চেষ্টা করবো কিভাবে জাপানে উচ্চশিক্ষা নেওয়া যাবে তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার। আপনারা ধারাবাহিক ভাবে পড়তে থাকুন আর জেনে নিন জাপানে উচ্চশিক্ষা নিতে আপনাকে যা যা করতে হবে তার বিস্তারিত তথ্য। প্রথমে আপনাদের জানিয়ে দেবো জাপানের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় কোন গুলো রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে।
জাপানের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা
জাপানের অসংখ্য প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আর এখানে কিছু শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যায়ের নাম দেওয়া হলো, ইউনিভার্সিটি অব টোকিও, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, ওসাকা ইউনিভার্সিটি, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, তোহুকু ইউনিভার্সিটি, কানাজাওয়া ইউনিভার্সিটি, ওকায়ামা ইউনিভার্সিটি, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স, টোকিও মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটি, টোকিও মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটি, ওসাকা সিটি ইউনিভার্সিটি, নিগাতা ইউনিভার্সিটি, কুমামোতো ইউনিভার্সিটি, তোকুশিমা ইউনিভার্সিটি, ওসাকা প্রিফেকচুয়াল ইউনিভার্সিটি, গিফু ইউনিভার্সিটি, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ইয়োকোহামা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও কাগোশিমা ইউনিভার্সিটি।
জাপানে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা
বিশ্বের প্রতিটি দেশে যেমন উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ রয়েছে। তেমনি জাপানে পাঁচ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ অব টেকনোলজি, জাপানিজ স্টাডিজ ও প্রফেশনাল ট্রেনিং স্কুল। এগুলো নিয়ে জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
জাপানে শিক্ষাবর্ষ ও কোর্সের মেয়াদ
জাপানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে থাকে এপ্রিল মাস থেকে, যা পরবর্তী মার্চ মাসে শেষ হয়। সাধারণত একটি শিক্ষাবর্ষ দুটি সিমেস্টারে বিভক্ত একটি এপ্রিল-সেপ্টেম্বর এবং অন্যটি অক্টোবর-মার্চ। তবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি সুযোগ থাকে, Fall Semester অর্থাৎ, এই সেমিস্টার শুরু হয় ১ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ সেমিস্টারে।
আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে বেশির ভাগ কোর্সের মেয়াদ চার বছর। এছাড়া মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি ও ভেটেরিনারি সায়েন্সের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ ছয় বছর করে। তবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের জন্য মেয়াদ দুই বছর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি বা PHD এর কোর্সের মেয়াদ তিন বছর। কোন কোন সময় মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি ও ভেটেরিনারি সায়েন্সের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ চার বছরও হয়ে থাকে।
জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা
জাপানে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বা উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে ভর্তির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম ১২ বছর স্কুলিং অর্থাৎ, যে কোন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট অর্জন করতে হবে। আর মাস্টার্সে ভর্তির জন্য অন্তত ১৬ বছরের স্কুলিং থাকতে হবে। এছাড়া জাপানে বেশির ভাগ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাপানি ভাষায় পাঠদান করা হয়।
কাজেই বিদেশি শিক্ষার্থীরা জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য যেতে চাইলে অবশ্যই একজন শিক্ষার্থীকে জাপানি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে যেতে হবে। তাই জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য যেতে চাইলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ঢাকায় অ্যাম্বেসিতে যোগাযোগ করে জাপানি ভাষা শিখতে পারেন। এছাড়াও আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন মেয়াদের জাপানি ভাষা শেখার কোর্স রয়েছে।
আপনি যখন জাপানে উচ্চশিক্ষা নিতে যাবেন তখন আপনাকে খুঁজতে হবে কোন প্রতিষ্ঠানে IELTS কেমন চায় তা জেনে নিতে হবে। কেননা, কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টোফেল সিবিটি স্কোর ১৫০-এর ওপর অথবা টোফেল আইবিটি স্কোর ৫২-এর ওপর চায়। আর এই স্কোরের পরিপূরক হিসেবে IELTS 6.5/ 7.0 গ্রহণযোগ্য।
যেহেতু, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি TOEFL (CBT/ iBT) চায়, তাই জাপানের জন্য TOEFL (CBT/ iBT) পরীক্ষায় বসাই আপনার জন্য উত্তম। তবে সব কোর্সে আর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পরীক্ষার প্রয়োজন পড়েনা। তাই আপনি জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইট ঘুরে দেখে নিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসলে কি কি যোগ্যতা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আশা করে।
জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য আবেদন প্রক্রিয়া
জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আবেদন করার জন্য যে সকল প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস লাগবে তার তালিকা নিচে পয়েন্ট আকারে তুলে দেওয়া হলো।
১। একাডেমিক সার্টফিকেট।
২। একাডেমিক মার্কশীট বা নম্বরপত্র।
৩। TOEFL/ JLPT 5 এর সনদ।
৪। CV বা মোটিভিশন লেটার ও রিকমেন্ডেশন লেটার।
৫। শেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র।
৬। পাসপোর্টের কপি।
জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য যেসব বিষয় পড়ানো হয়
আপনি জাপানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনে যেসব বিষয় নিয়ে পড়তে পারবেন তা হলো,
১। বিজ্ঞান বিষয় : পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, পরিবেশবিদ্যা, প্রাণবিজ্ঞান, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স,বায়োলজি অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স, ভূ-বিজ্ঞান, এডুকেশনাল সায়েন্স, এনভায়রনমেন্টাল লাইফ সায়েন্স,জোতির্বিদ্যা, বায়োসায়েন্স ও বায়োটেকনোলজি, বায়োমলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিং,
২। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে : হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, এরিয়া স্টাডিজ,
৩। মানবিক বিষয়ে : হিউমান স্টাডিজ, মানববিদ্যা,পাবলিক ল অ্যান্ড পলিসি,ফলিত তথ্যবিজ্ঞান, হিউম্যান-সোশ্যাল ইনফরমেশন সায়েন্স, ভূ-প্রকৃতিবিদ্যা, স্থাপত্য ও ভবনবিজ্ঞান,
৪। আইন বিষয় : ল অ্যান্ড সোসাইটি, ট্রান্সন্যাশনাল ল অ্যান্ড পলিসি,
এছাড়া রয়েছে, ভাষাশিক্ষা, ইতিহাস, অর্থনীতি, গণিত, মেকানিক্যাল সিস্টেমস অ্যান্ড ডিজাইন, ন্যানোমেকানিকস, এডুকেশনাল ইনফরমেটিকস, আন্তসাংস্কৃতিক সম্পর্ক, ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পিউটার অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স সহ ইত্যাদি বিষয়ে। জাপানে উচ্চশিক্ষা এর জন্য প্রায় ৭০০ এর মতো ইউনিভার্সিটি রয়েছে। সারা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাপানের আছে “দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ টোকিও” এবং “কিয়োটো ইউনিভার্সিটি”। আর সেরা ৫০০ ইউনিভার্সিটির মধ্যে জাপানেই আছে ১৬টি ( ARWU)।
ভিসার জন্য আবেদন প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
জাপানে ভিসা আবেদনের প্রথম ধাপে, আপনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি কনফার্ম হওয়ার পর। আপনাকে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জাপান ইমিগ্রেশন দপ্তরে জমা দিতে হবে। তারা আপনার সকল ডকুমেন্টস গ্রহণ করবে আর Ministry of Justice in Japan- এর মাধ্যমে Pre-Visa (COE) প্রদান করবে। এই Pre-Visa (COE) নিয়ে আপনি পরবর্তীতে ভিসার জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত জাপান এম্বেসীতে আবেদন করবেন।
১। Pre-Visa (COE)।
২। সকল ডকুমেন্টস, মার্কশিট ও সকল সনদ।
৩। পাসপোর্ট ন্যুন্যতম ছয় মাস মেয়াদ আছে এমন।
৪। দুই কপি ছবি সাইজ ৩.৫ দ্ধ ৪.৫।
৫। রিকমেন্ডেশন বা রেফারেন্স লেটার।
৬। ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও আর্থিক স্বচ্ছলতার ডকুমেন্টস।
৭। মেডিকেল রিপোর্ট।
৮। TOEFL/ JLPT 5 এর সনদ (যদি থাকে)।
৯। স্কলারশিপের পেপার (যদি থাকে)।
১০। জাপানে উচ্চশিক্ষা এর কারন বর্ণনা করে একটি কভার লেটার জমা দিতে হবে।
এছাড়া আপনার আরো কোন কাগজ পত্র লাগবে কিনা তা জাপান দূতাবাস থেকে জেনে নিতে হবে।
বাষিক টিউশন ফি বা পড়াশুনার খরচ
জাপানের টিউশন ফি নির্ভর করে আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবেন তার উপর। আপনি যদি ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়াশুনা করেন। তাহলে আপনার বছরে পড়াশুনার খরচ হবে ১০ হাজার মার্কিন ডলারের মত। আর লোকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার টিউশসন ফি হবে ১১,৩৭৭ মার্কিন ডলার। এছাড়া আপনি যদি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তাহলে বাষিক টিউশন ফি হবে ৭,৯৫৯ থেকে ৬১,১২৩ মার্কিন ডলার প্রতি বছর।
বাসস্থানের সুযোগ সুবিধা ও খরচ
জাপানে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা চার ধরনের বাসস্থানে বসবাস করতে পারবেন। এই চার ধরনের বাসস্থান গুলো হচ্ছে, স্টুডেন্ট ডরমিটরি, স্থানীয় সরকারি সংস্থা কর্তৃক বরাদ্দকৃত পাবলিক হাউজিং, জাপানিজ বিভিন্ন সংস্থার স্টাফ ডরমিটরি ও ব্যক্তিগত বাসা ভাড়া। এছাড়া টোকিওতে একজন শিক্ষার্থীর জন্য বাসস্থান খরচ মাসিক প্রায় ১,৫৮,০০০ ইয়েন আর শিকাকুতে এটা প্রায় ১,১৭,০০০ ইয়েন।
এতো গেল আবাসিক খাতের খরচ আর জাপানে থাকতে গেলে তো আপনাকে খেতে হবে। এর জন্য আবার আপনাকে বাড়তি খরচ দিতে হবে। এখানে খাবার থেকে শুরু করে যাতায়াত, টেলিফোন, ওয়াই ফাই ইত্যাদি বাবদ আপনাকে বছরে খরচ করতে হবে ১,৩৫,৭৮৭ থেকে ১,৮০,২৮০ ইয়েন। এছাড়া আপনাকে হেলথ ইন্সুরেন্স এ বছরে সাধারনত ১৮,২০০ ইয়েন দিতে হবে।
জাপানে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে আমাদের শেষকথা
জাপানে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশশি আপনি সপ্তাহে ২৮ ঘন্টা কাজ করতে পারবেন। আর মাসে পড়াশুনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করতে পারবেন ১২০ ঘন্টা। এছাড়া ছুটির সময় তো পাবেন ফুল টাইম জব করার সুযোগ। জাপানে পার্ট টাইম জব করে ঘন্টায় পাওয়া যায় ৯০০-১২০০ ইয়েন। যা বাংলাদেশি টাকা ৭০০-৯০০ টাকার সমতুল্য। এই জব করেই আপনি আপনার টিউশন ফি কমাতে পারবেন। তাই জাপানে উচ্চশিক্ষা শেষে আপনি স্টুডেন্ট ভিসাকে পরিবর্তন করে ফুল টাইম ভিসা করতে পারবেন। আর আপনি চাইলেই এই ভিসা নিয়ে আপনি যত দিন ইচ্ছে জাপানে থাকতে পারবেন। এমনকি ৩ বছর পর স্থায়ী বসবাসের জন্য জাপানের নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন।
এছাড়া আপনি, আমেরিকার উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে পড়তে পারেন। ধন্যবাদ